ছোট গল্প ' দূরে কোথাও '

ছোট গল্প ' দূরে কোথাও '

----- মোঃ আজহারুল ইসলাম জুয়েল

Published in newspaper:

1. https://drive.google.com/file/d/1c_Rzxfmp7B9t_Qv77SShSsg_8QrdLb5q/view?usp=drive_link

2. https://nagorik.prothomalo.com/ayojon/8yc6z2jox7 

----

পুকুরটা কত বড় হবে তা বুঝতে না পারলেও অনুমান, এরকম পুকুর জীবনে এই প্রথম, পুকুরের পাড়গুলো যেন অন্ধকারের রাজ্য, দিনের বেলায়ও নিজের শরীর দেখতেও চোখ বড় বড় করতে হয়, ঐ যে, আমাদের মহারাজার দিঘী অথবা রামসাগর, ওরাও লজ্জা পাবে পুকুরটার বিশালতায়! তবে সৌন্দর্য্যে বিমোহিত হয়েও এর পুরোটা দেখার সৌভাগ্য হয়নি আমার। আমার গিন্নীসহ বেড়ানোর এক ফাঁকে এই রকম বিশাল পুকুরের সন্ধান পাবো তা কল্পনায় আসেনি কখনো। হেঁটে চলছি আমরা, মাঝে মধ্যেই সূর্যের আলোর হাতছানিতে চোখে পরছে পুকুর পাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য্যের সমারোহ। এরকম উচু সারি সারি গাছ টিভিতে দেখেছিলাম বহুবার, আজ স্বচক্ষে। হঠাতই পায়ের জুতোয় কিছু একটা আটকানো অনুভব করতে জুতাটা খুলতে খুলতেই হাত থেকে ছিটকে কোথায় যেন হারিয়ে গেল, ঠাওর করতে পারছিলাম না, অগত্যা জুতোর অভাবে বৌকে বললাম, “ তুমি ঠিক আছো তো? আমি তো আর হাটতে পারছি না!” পা’য়ে কোন কিছু একটা বিঁধবে এই ভয়ে, এভাবে কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় দাড়িয়ে আছি, হঠাতই এক অপরূপা ষোড়শী এসে আমাদের সামনে এসে দাড়ালো, আমার ভ্রম ধরেনি তো! নিজের চোখগুলোকে পরীক্ষা করছিলাম, না ঠিকই দেখছি; মেয়েটি আসলেই সামনে দাড়িয়ে, হাতে সেই আমার হারিয়ে যাওয়া জুতোটা। জুতোটা নেয়ার কথা ভুলে গিয়ে তাঁকিয়ে আছি অপলক দৃষ্টিতে, জীর্ণ শীর্ণ পোশাকে আর মুখমন্ডলে ঘামের সাথে কালো দাগে মিশে গেলেও আলতো দুধে মেশানো রংটি কিন্তু ঠিকই ফুটে উঠেছে! মেয়েটি আংকেল বলে ডাকতেই যেন আমার হুঁশ হলো, দেখলাম, একহাতে গাছের শুকনা ডালপালার একটি ছোট বোঝা, অন্য হাতে আমার জুতোটা,

“ আংকেল, এটা মনে হয় আপনার? খড়ি কুড়োতে গিয়ে পেলাম, তাই এদিক ওদিক খুঁজতে খুঁজতেই আপনাদের পেয়ে গেলাম। ” আমার বৌ শুধু মেয়েটির দিকেই তাঁকিয়ে আছে, কোন কিছুই বলছে না। আমি জুতোটা পায়ে দিয়েই মেয়েটিকে জিগ্যেস করলাম তার নাম ও বাড়ি। মেয়েটি বললো, " চৈতী, থাকি ঐ যে নীচে, একটা ছোট ঘরে, মামা মামীর সাথে।"

“ খড়ির বোঝাটা রাখো তো বেটি, চলো, আমাদের একটু পথ দেখাও।” মেয়েটি সাঁয় দিয়েই আমাদের সাথে খুব ধীর গতিতে হেঁটে চললো, আমরাও চারপাশ অবলোকন করতে করতে চলছি, হঠাতই দেখি আমার স্ত্রী অনেক পিছনে, আর সে চিৎকার করে বলছে, “ দেখো তো, এই মহিলাটা আমার পথ আটকিয়ে ধরছে, যেতে দিচ্ছে না!” আমি মহিলাটার কাছে গিয়ে খুবই চড়া গলায় গালি দিচ্ছি আর তখনই চৈতী গিয়ে মহিলাটিকে ধাক্কা দিয়ে তাঁর আন্টিকে আগলিয়ে নিলো, মহিলাটি এবার খুব অদ্ভুত স্বরে কাকে যেন ডাকতেই অদ্ভুত রকমের এক বিদ্ঘুটে লোক ধাঁরালো অস্ত্রসহ আমাদের পথরোধ করলো, আমি ভয় না পাওয়ার ভান করে তাদের সামনে থেকে সরিয়ে যেতে বলাতেই ঐ বিদ্ঘুটে চেহারার লোকটি আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো, আমিও সাহসের সাথেই মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত, জানি এরকম পরিস্থিতিতে মনের সাহসটাই বড় কথা, তাই লোকটার থেকে আমিই একটু এগিয়ে গেলাম। বিদ্ঘুটে লোকটা তার বিশাল ধাঁরালো অস্ত্র নিয়ে তেঁড়ে আসতেই নিমিষেই কে যেন তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল আর আমি তৎক্ষনাৎ লোকটার দুইপা ধরে, দুটো ঘুরানী দিয়ে বনভোজনের জন্য রান্না করার বড় একটি পরিত্যক্ত চুলার মধ্যে তার মাথাটা ঢুকিয়ে দিলাম ঠান্ডা ছাইয়ে। বিদ্ঘুটে লোকটার কাতরানি দেখার মত! ঠিক ঐ মুহূর্তে দেখতে পেলাম তিরিশোর্ধো ফর্সা রং এর হালকা পাতলা গড়নের এক যুবক যে ঐ বিদ্ঘুটে লোকটিকে বিদ্যুতের গতিতে এসেই ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলো। আর ঐ যে মহিলাটা, তার চুলের মুঠি ধরে আমার স্ত্রী আর চৈতি মাটিতে ফেলে দিয়ে খড়ি দিয়ে বেধড়ক পেটাতে শুরু করে দিয়েছে, আর আমার হাতে তখনো ধরা আছে বিদ্ঘুটে লোকটার পা’দুটো যার মাথাটা চুলোর ছাইয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছি। বেশ কিছুক্ষণ পর ঐ মহিলা ও লোকটাকে ছেড়ে দিয়ে একখানে বসিয়ে তাদের মুখ থেকে কথা নিলাম আর কখনো কারো সাথে যেন ওরকম আচরণ না করে, তারা আমাকে বাপ ডেকে তওবা করে বললো, " যতদিন বেঁচে আছি, এই পাহাড়ে যাঁরা আসবে তাঁদের সেবা করে যাবো " তাদের ছেড়ে দিয়ে যুবকটিকে জিগ্যেস করলাম, তাঁর নাম ও বাসা। " থারুপা কুমার, নেপালী, থাকি ঐ যে দুরে পুকুরের অপর কোনের নীচে।"

" তুমি এদেশে কিভাবে এলে? কবেই বা এসেছো?" " এখন আর মনে নেই স্যার, তবে আমার বাড়ি নেপাল এটা মনে পড়ে, অনেক বছর হলো তো! "

‘ চৈতি ’ আর ‘ থারু ‘-র ওরকম অসহায়ত্ব জীবনের কথা শুনে মুখ থেকে আর কোন কিছু উচ্চারণ করতে পারছিলাম না আমি, আমার স্ত্রীরও মুখে কোন কথা নেই। আমাদের কিছু খাবার ছিলো সাথে, একখানে বসে চৈতী আর থারুকে বললাম খেতে, তাঁরা চুপচাপ খেতে লাগলো। চৈতীকে শুধু জিগ্যেস করলাম, " তুমি খড়ি কুড়োতে আসো কেন? তোমার মামা মামী তো আছে?” সে এমনভাবে কেঁদে দিলো হাউমাউ করে, যেন কোনদিন এভাবে কান্না করেনি কখনো। আর থারু দেখি খাওয়া বন্ধ করে চেয়ে আছে চৈতীর দিকে, হয়তো ভালোবাসা জেগে উঠেছে মনে!

ধ্যাত্! এতক্ষন তবে স্বপ্ন দেখছিলাম!

হ্যাঁ, স্বপ্নেই এসব দেখা কিন্তু তবে তারপর কি হলো তা না শুনে যাবেন কি করে!

" থারু...." " ও থারু....." খুবই মৃদু স্বরে ডাকছিলাম আমি।

এবার যেন হুশ ফিরে এলো থারুর, " জী স্যার! হ্যাঁ স্যার! বলেন স্যার! "

" আরে কি দেখছিলে অমন করে? ওর নাম চৈতী, থাকে ঐখানে নীচে, তাঁর মামা মামীর সাথে। যতটুকু দেখলাম, সে খুব ভালো মেয়ে।” আমার এরকম কথা শুনে থারু যেন লজ্জা পেয়ে গেলো, একেবারে লজ্জায় লাল হয়ে গেছে বেচারা! আর কথা বের হয় না। আমিই তাকে সাহস যুগিয়ে বললাম,

" নাও, তারাতারি খেয়ে নাও। কোন একদিন তোমাকে নিয়ে চৈতীদের বাড়ীতে যাবো।" এবার বেচারার খাওয়া আটকে গেছে গলায়, কথাই বলতে পারছে না দেখে চৈতীকে বললাম, " থারুকে ঐ পানির বোতলটা দাও তো বেটি।" বলা মাত্রই চৈতী পানির বোতলের ছিপিটা খুলে, খুবই যত্ন সহকারে থারুর হাতে এগিয়ে দিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, " নাও, পানি খাও। ঠিক হয়ে যাবে।" থারু পানি পান করছে ঠিকই কিন্তু চোখগুলো নিবিষ্ট হয়ে আছে আবারো সেই চৈতীর দিকে। সে হয়তো অবাক হয়ে চৈতীর এমনভাবে কথা বলা ভাবতেই পারেনি।

হ্যাঁ, এই সেই মেয়ে চৈতী, থাকে মামা মামীর সাথে ছোট এই সাগর পাড়ের নীচে, ঐ ছোট ঝুপড়ি ঘরে।

" আংকেল, তোমরা যাবে আমাদের বাড়ীতে? "

" অবশ্যই বেটি! তোমার আন্টিসহ যাবো দুএকদিনের মধ্যে। থারু, তুমিও যাবে আমাদের সাথে। "

আমার এরকম আপনভাবে কথা বলা শুনে, দেখলাম, চৈতীর চোখগুলো থেকে যেন হঠাতই আবার বৃষ্টি নেমে এলো কিন্তু এটা কান্না না আনন্দাশ্রু তা পরে বুঝতে অসুবিধা হয়নি।

তবে চৈতী কিন্তু চেষ্টা করলো তার চোখের পানি আড়াল করতে চোখে কিছু একটা পরেছে সেই অজুহাতে। তবে মুহূর্তেই মেঘের আড়ালে সূর্যের হাসির মতই চমৎকার ফুটে উঠলো চৈতীর চোখে মুখে সুখের সাগরে ভেসে বেড়ানো অফুরন্ত হাসির ফোয়ারা! এ যেন স্বর্গসুখ তার কাছে! আর সেই হাসিমাখা মুখখানা দেখতে দেখতে কখন যে চৈতী এসে আমাদের পা ছুঁয়ে সালাম করলো বুঝতেই পারিনি। এবং আমাদের কাছে এসে এমনভাবে ঘেঁষে দাড়ালো যেন সে মনে করছে, সেই রাজ্যের সে এখন রাজকুমারী আর রাজকন্যার তদারকিতে নিয়োজিত আছি আমরা দুই রাজারানী।

কি আর করা! এমন মায়াবী মেয়েটাকে পেয়ে আমরাও দুজনেই আনন্দে জড়িয়ে ধরলাম চৈতীকে। এরকম সুখও যে পৃথিবীতে আছে চৈতী হয়তো এবারই প্রথম অনুভব করলো কারণটা অন্য কোন একসময় বলবো আপনাদের।

থারু কিন্তু এবার কথা বলতে শুরু করলো,

" স্যার, আমি এতবছর থেকেই এখানে আছি, পাড়গুলো আমার খুবই চেনা কিন্তু চৈতীকে কোনদিন চোখে পড়েনি, আপনাদের সাথে কেমন করে পরিচয় হলো তাঁর? বুঝতেই পারছি, আপনারা আজকেই প্রথম এসেছেন এই বিশাল পুকুর আর এর পাড়ের শোভা উপভোগ করতে।"

" আরে থারু! তোমার কথা বলো, চৈতীকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। ধরে নাও, সে আমাদেরই মেয়ে!, এবার হলো তো?"

" জী স্যার! তো আমি যেখানে থাকি সেখানেও কিন্তু যেতে হবে স্যার। "

" কেন? চৈতীর বাড়ীতে যাবো তাই তোমার হিংসে হয় নাকি? আচ্ছা, তোমার আন্টিসহ চৈতীকে নিয়ে একদিন তোমার বাড়িতেও যাবো, ঠিক আছে?"

"জী স্যার, আমাকে কিন্তু দু’একদিন আগেই বলবেন স্যার যখন যাবেন।"

" আচ্ছা, জানিয়ে যাবো।"

চৈতী কিন্তু এবার অভিমানের সুরে থারুর দিকে ইংগিত করে বলল, " যাওয়ার আগে তাকে জানিয়ে যেতে হবে! তার মানে সে বাড়িতেই থাকে না! বুঝেছ আংকেল? এই, তোমাকে জানিয়ে যেতে হবে কেন?" এবার সরাসরি থারুর দিকে কড়া গলায় ধমকের স্বরে বলেই ফেললো চৈতী।

থারু ও চৈতীর সাথে কথা বলতে বলতে হঠাতই আবার সেই মহিলা আর বিদ্ঘুটে লোকটা এসে আমাদের সামনে বসে পেয়ারাভর্তি একটা ঝুড়ি রেখে মহিলাটি বললো, " বাপজান, তোমাদের জন্য এনেছি, এগুলো তোমরা বাড়িতে নিয়ে যেও।" তাদের এরকম পরিবর্তন দেখে আমি কি বলবো আর ভাষা খুজে পেলাম না! চৈতীকে শুধু বললাম, " নাও চৈতী, পেয়ারা খাও, থারুকেও দাও।" চৈতী কিন্তু পেয়ারাগুলো বোতলের পানি দিয়ে ধুইয়ে আগে আমাকে ও তার আন্টিকে দিল, তারপর থারুকে দিয়ে বলল, " খাও, এবার যেন আবার গলায় আটকে না যায়!"

হাতে পেয়ে আমি পেয়ারাটাতে কামড় বসাতে যাবো ঠিক ঐ মুহুর্তে আমার স্ত্রীর ডাকে ঘুম ভেংগে গেলো, নিজেকে আবিষ্কার করলাম সেই প্রতিদিনের মতই বিছানায়! ঘড়িতে দেখি সকাল আটটা। সত্যি, এতক্ষণ তবে স্বপ্নেই হারিয়ে গিয়েছিলাম ' দুরে কোথাও ’

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

Comments

Popular posts from this blog

অবসরপ্রাপ্ত বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী, কল্যাণ তহবিল ও অবসর সুবিধা ও প্রেক্ষিত

বিশ্ব শিক্ষক দিবস ২০২৫ ও বাংলাদেশের শিক্ষক সমাজ

ড. মুহাম্মদ ইউনূস, জাতীয় সরকার ও প্রেক্ষিত