পঞ্চগড়, সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্প ও করনীয়
পঞ্চগড়, সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্প ও করণীয়
-- আজহারুল ইসলাম জুয়েল
Published in newspaper:
- https://drive.google.com/file/d/1e06Us6gaQgGqAcE6mwH4J6ItqBSNPPdO/view?usp=sharing
- https://nagorik.prothomalo.com/reader/4iua96qyex
---------------------------------
হিমালয়কন্যা খ্যাত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা বাংলাদেশের উত্তরের সমতলভুমি সরল সাধাসিধে শান্ত প্রকৃতির মানুষের এলাকা পঞ্চগড় ইতোমধ্যে দেশ-বিদেশে পরিচিতি পেয়েছে চা শিল্পের জন্য আর তার সাথে বাড়তি পাওয়া প্রকৃতির নয়নাভিরাম কাঞ্চনজঙ্ঘা। এছাড়াও উন্নতমানের বালি আর পাথরের জন্য নামডাক তো আছেই আমাদের এই হিমালয় কন্যার। উপরন্তু এর সাথে সরকারি বেসরকারি এনজিও ও ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠা কিছু বিনোদন পার্ক চাবাগান যেমন তেঁতুলিয়া ডাকবাংলো আনন্দধারা ইকোপার্ক হিমালয় পার্ক সহ অসংখ্য চাবাগান ঐতিহাসিক কিছু জায়গা যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য মহারাজার দিঘী রাবার ড্যাম মির্জাপুর শাহী মসজিদ বোদেশ্বরী মন্দির ও রক্স মিউজিয়াম। আর অসংখ্য ছোট বড় নদনদীর প্রাকৃতিক দৃশ্য যা পর্যটকগণ উপভোগ করে থাকেন। এমনকি বিভিন্ন প্রজাতির বন্য প্রাণী পাখপাখালি জীববৈচিত্র্যে ভরপুর পঞ্চগড় বাংলাদেশের অন্যতম এক দর্শনীয় এলাকা হিসাবে সারাদেশে সমাদৃত হয়েছে তবে পর্যটক আকর্ষণে সত্যিকার অর্থে পর্যটন নগরী হিসাবে পঞ্চগড় এখনও ভ্রুনই থেকে গেছে যা হয়তো সবার অক্লান্ত পরিশ্রমে একটি সুস্থ সবল শিশুর জন্মের মতই পঞ্চগড় এর আবির্ভাব ঘটতে পারে। পঞ্চগড়কে পর্যটন শিল্পের শৈশবে এবং শৈশব থেকে যৌবনে গড়ে তুলতে হলে সভা সেমিনার আলোচনা গবেষনা ও সর্বোপরি ব্যক্তি উদ্যোগকে উৎসাহ উদ্দীপনা যোগানোর পাশাপাশি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ও পর্যটনশিল্পের সার্বিক উন্নয়নকল্পে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। পঞ্চগড়ের প্রকৃতি পরিবেশ প্রতিবেশ ইতিহাস ঐতিহ্য কৃষ্টি কালচার ভাষা সংস্কৃতি সমুন্নত রেখে পুরোপুরি পর্যটন নগরী হিসাবে গড়ে তুলতে পারলে একদিকে যেমন দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়বে তেমনি এলাকার মানুষের জীবনযাত্রার উন্নতি হওয়ার পাশাপাশি রাষ্ট্রের আয়ও অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে যা জাতীয় আয়ে অবদান রাখতে পারে। অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার চেয়ে হয়তো অনেক কম বাজেটেই পঞ্চগড়কে একট আকর্ষণীয় পর্যটন নগরীতে পরিনত করা যেতে পারে আর এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে সরকারের কর্তাব্যক্তি জেলা প্রশাসন পুলিশ প্রশাসন সংশ্লিষ্ট দপ্তর যেমন বনবিভাগ পানিসম্পদ বিভাগ রাজনীতিবিদ আইনপ্রনেতা জনপ্রতিনিধি সমাজকর্মী সাংবাদিক শিক্ষক পরিবেশবিদ পরিবেশকর্মী মটরমালিক মটর শ্রমিক অটোরিক্সা শ্রমিক এবং পর্যটনশিল্প সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানসহ স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী অভিভাবকদের সমন্বয়ে এক যৌথ সভা করে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহন করা জরুরি। পর্যটন শিল্পের উপকারিতা এবং এর ফলে আর্থসামাজিক অবস্থা উন্নয়নের সুফল সভা সেমিনারের মাধ্যমে জনসচেতনতামূলক প্রচার প্রচারনা করে পঞ্চগড়কে পরিবেশবান্ধব দৃষ্টিনন্দন পর্যটন এলাকায় পরিনত করতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহন করা যেতে পারে। সেই সাথে পঞ্চগড়ের প্রতিটি নাগরিককে পর্যটন শিল্পের গুরুত্ব অনুধাবন করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ হাটবাজারে প্রচার-প্রচারনার মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করার ব্যবস্থা করতে হবে। হিমালয় কন্যাকে পর্যটন নগরী হিসাবে গড়ে তুলতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হলোঃ
১। ঐতিহাসিক স্থাপনাসমূহের সংস্কারকরন ২। সীমান্ত সংলগ্ন এলাকাগুলিকে পশু পাখিদের অভয়ারণ্যে পরিনত করন ৩। পর্যটন মানবিক নিরাপত্তা বাহিনী গঠন ৪। এলাকাভেদে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার ওয়াচ-টাওয়ার গঠন ৫। নদনদী গুলোর সংস্কারকরণ ৬। মহারাজার দিঘীর সংস্কারকরণ ৭। বাংলাদেশের ইতিহাসে বিখ্যাত ব্যক্তিদের ও পঞ্চগড়ের ইতিহাসে ব্যক্তিদের অবদানসম্বলিত তথ্যসমূহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রদর্শনের ব্যবস্থা গ্রহণ। ৮। বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরকে আশপাশ দূষণমুক্ত করণে কার্যকরী ব্যবস্থাগ্রহন ৯। বনভুমিগুলোর সংস্কারসহ ঔষধি গাছ লাগানো ও চলাচল উপযোগী রাস্তার ব্যবস্থাগ্রহন ১০। পঞ্চগড়ের প্রবেশ পথে দিকনির্দেশনামূলক সাইনবোর্ড স্থায়ী বিলবোর্ড ১১। বিশেষায়িত পর্যটন বাস, পরিবেশ বান্ধব রিক্সা ভ্যান চালনায় উদ্বুদ্ধকরণ ১২। সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে এক অথবা দুইটি বিশেষায়িত পর্যটন স্কুল কলেজ স্থাপন ১৩। পঞ্চগড়ের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যবাহী খাবারসহ দেশি-বিদেশি খাবারের সেফ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ১৪। ট্যুরিস্ট গাইড বা পর্যটক সহায়ক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন ১৫। লোকাল রাস্তাগুলোর সংস্কারসহ রাস্তার পাশে সৌন্দর্যমণ্ডিত বিশ্রামাগার ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা গ্রহন ১৬। মানবিক পরিচ্ছন্নতাকর্মী গঠনে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন ১৭। উৎসাহী ও উদ্যমী যুবক কৃষকদের উদ্ভাবনী দক্ষতা কাজে লাগানোর জন্য প্রণোদনাসহ দেশি-বিদেশি কৃষিজাত দ্রব্য উৎপাদনে উৎসাহিত করণ ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ ১৮। চা শিল্পের উন্নয়নে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ।
*বর্তমান বিশ্বে এমন অনেক দেশ আছে যাদের জাতীয় আয়ের একটা বৃহৎ অংশ পর্যটন শিল্প থেকেই আসে। আমাদের দেশও এর ব্যতিক্রম নয় তবে বিশ্বের বাজারে পর্যটন শিল্পে ততটা ভালো অবস্থান না থাকলেও ভবিষ্যতে যে পর্যটন শিল্পে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করতে পারে তা বলাই বাহুল্য এবং তা উত্তরবঙ্গের হিমালয় কন্যা পঞ্চগড় থেকেই শুরু হতে পারে। এক্ষেত্রে পঞ্চগড় যেহেতু ভৌগোলিক এমন এক অবস্থানে যার সাথে সড়ক পথে এশিয়া মহাদেশীয় বেশ কয়েকটি দেশের পর্যটকদের আকর্ষণ করতে পারে দেশীয় পর্যটকদের পাশাপাশি। আমাদের পঞ্চগড় কৃষি ক্ষেত্রে অনেক সাফল্যের সাথে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু মাঝে মাঝে আন্ত দেশীয় বাজার ব্যবস্থাপনার ত্রুটবিচ্যুতির কারণে সম্ভাবনাময় কৃষিজাত পন্যের নাজুক পরিস্থিতি আমাদের হতাশাজনক অবস্থায় পরতে হয়। তাই যেহেতু প্রকৃতির অপরূপ সমতল ভূমি পঞ্চগড়ের প্রতি দেশি-বিদেশি পর্যটকদের একটু আগ্রহ এমনিতেই দেখা যায় তবে সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্প এলাকা হিসাবে পঞ্চগড়কে গড়ে তুলতে পারলে আর্থসামাজিক অবস্থা উন্নয়নের পাশাপাশি সার্বিকভাবে পঞ্চগড়ের সকল পেশার মানুষ উপকৃত হওয়ার সাথে সাথে ব্যপক কর্মসংস্থানের দ্বার উন্মোচিত হতে পারে যা বেকার সমস্যা সমাধানে এক বিশাল ভূমিকা পালন করতে পারে। তাই বিশেষ কয়েকটি এলাকা বা স্থান যা পর্যটকদের আকর্ষণ করছে সেই সব এলাকা সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে আরো নান্দনিক ও আকর্ষণীয় করতে পারলে হয়তো অনেক বেশি সুফল পাওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে তেঁতুলিয়া ডাকবাংলোর একটা ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে তাই ডাকবাংলোকে পর্যটনের মডেল এলাকা হিসাবে চিহ্নিত করে বিশিষ্ট স্থপতি ও প্রকৌশলীগনের সহায়তায় তেঁতুলিয়া ডাকবাংলোসহ এর আশপাশের এলাকাগুলোকে পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিনত করা এখন সময়ের দাবী। *ভিতরগড়ের মহারাজার দিঘীও ঐতিহাসিকভাবে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং বহু পৌরাণিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে পরিপূর্ণ পর্যটন শিল্পের জন্য একটি যথার্থ এলাকা। ভিতরগড়ের মহারাজার দিঘী নিয়ে বেশ কয়েকজন গবেষকের গবেষণার ফলে দেশ-বিদেশে প্রচার প্রসার ঘটেছে তাই ঐতিহাসিক এই প্রত্নস্থলকে ঢেলে সাজাতে পারলে পর্যটন শিল্প অগ্রনী ভূমিকা পালন করবে এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। *তেমনি মোঘল আমলে নির্মিত আটোয়ারীর মির্জাপুর শাহী মসজিদ পর্যটক আকর্ষণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান তবে এর পারিপার্শ্বিক অবস্থার উন্নয়ন করতে পারলে আরো নান্দনিকভাবে উপস্থাপন করতে পারলে পর্যটন শিল্পে নতুন মাত্রা যোগ হতে পারে। *বাংলাবান্ধা যেহেতু এখন স্থলবন্দর এবং প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ পারাপার হয় তাই বাংলাবান্ধাকে পরিবেশবান্ধব ও আকর্ষণীয় করে তুলতে পারলে পর্যটকদের সময় কাটানোর এক বিশেষ এলাকা হিসাবে চিহ্নিত হতে পারে। *তাছাড়া হিন্দু ধর্মীয় দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি স্থান যেমন বদেশ্বরী মন্দির তীর্থস্থান বারুনীমেলাসহ পঞ্চগড় জেলার বহু এলাকায় দর্শনীয় কিছু ঐতিহাসিক মসজিদ ঈদগাহ আছে যা হয়তো অনেকেরই জানা নেই সেগুলোর দৃষ্টিগোচর করতে পারলে পর্যটকদের জন্য বাড়তি কিছু হতে পারে এবং এরকম একটি ঈদগাহ বোদা উপজেলার চন্দনবাড়ি গোমস্তাপাড়া ঈদগাহ-র নাম বলা যেতে পারে যা প্রায় দুইশত বছরের পুরোনো। *এছাড়াও ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠা অনেক স্থাপনা বিনোদন পার্ক নদনদীর চোখজুড়ানো দৃশ্যসহ পঞ্চগড়ের সীমান্ত এলাকার নয়নাভিরাম দৃশ্য। *সর্বোপরি পঞ্চগড়ের উত্তর পূর্ব পশ্চিম তিন দিকেই ভারত সীমান্তঘেষা এলাকাগুলোকে যদি পশু পাখিদের অভয়ারণ্যে পরিনত করা যায় তবে তা হবে পর্যটন জগতে অন্যতম উদ্ভাবন যেহেতু যুগ যুগ ধরেই অনেক দূর্লভ বন্য প্রাণী ছুটে আসে পঞ্চগড়ে। এছাড়াও শীতকালে সূদুর অস্ট্রেলিয়া আফ্রিকা মহাদেশ থেকে মৌসুমি পাখিদের বিচরণ পর্যটকদের বাড়তি পাওয়া হতে পারে। *সর্বশেষ ও সর্বাগ্রে যা দর্শনীয় সেই অপরূপ সৌন্দর্য্যের হাতছানি দেয়া কাঞ্চনজঙ্ঘা যার টানে পর্যটকদের একটা বড় অংশই আসে তাকে স্বচক্ষে উপভোগ করতে। তাই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার সুবিধার্থে সুবিধাজনক স্থানে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার বা ওয়াচ-টাওয়ার বসাতে পারলে হিমালয় কন্যা পঞ্চগড় পর্যটকদের টেনে আনবে বারবার একথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

লেখকঃ
আজহারুল ইসলাম জুয়েল
সিনিয়র শিক্ষক (ইংরেজি)
ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার কলেজিয়েট ইন্সটিটিউট পঞ্চগড়
পোস্টঃ পঞ্চগড় পোস্ট কোড- ৫০০০
ফোনঃ ০১৭১৬৮৪৯৮৪৮
ইমেইল- azharul1965@gmail.com
হোয়াটসঅ্যাপঃ ০১৭০১৯৮০১৮১
Comments
Post a Comment